• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ বিন কাসিম : ভারতের প্রথম মুসলিম সেনাপতি


মুজীব রাহমান মার্চ ৯, ২০২১, ০৪:১৪ পিএম
মুহাম্মদ বিন কাসিম : ভারতের প্রথম মুসলিম সেনাপতি

ঢাকা : ইরাকের শাসক হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ। তার সেনা কমান্ডার ও অন্যান্য সভাসদদের নিয়ে বসে আছেন রাজপ্রাসাদে। জনগণের নানা সমস্যা ও সমাধান নিয়ে আলাপ করছেন তারা। বাহির থেকে একজন অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কানে কী যেন বলল, ফিস ফিস করে। হাজ্জাজ তাকে বলল, যাও আগন্তুককে ভেতরে নিয়ে আসো। আগন্তুককে নিয়ে আসা হলো  ভেতরে । তার হাতে একটি পত্র। হাজ্জাজের কাছে তা দিয়ে আগন্তুক বলল, ‘এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ  চিঠি। সিন্ধুরাজ্য থেকে পাঠানো হয়েছে।’ হাজ্জাজ চিঠি খুলে পড়া শুরু করলেন। পড়া শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ তিনি ক্রোধে দাঁড়িয়ে গেলেন। তার রাগ দেখে  উদ্বিগ্ন হয়ে গেল পুরো সভাসদ। তাদের একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। এ চিঠিতে এমন কি আছে যে কারণে আপনি আপসেট হয়ে গেলেন? খলিফা ওয়ালিদ ইবনে মালিকের কি কোনো সমস্যা হয়েছে? শত্রুপক্ষের কেউ কি আমাদের রাষ্ট্রের কোথাও আক্রমণ করেছে? হাজ্জাজ কিছুক্ষণ দাঁতে কামড় দিয়ে চুপ করে রইলেন। এরপর প্রচণ্ড রাগে বলা শুরু করলেন, ‘শ্রীলংকার রাজা কয়েকটি জাহাজ পরিপূর্ণ করে আমাদের জন্য উপহারসামগ্রী পাঠিয়েছিল। জাহাজে কয়েকজন মহিলাও ছিলেন। তাদের যাত্রাপথে দেবল নামক স্থানে কয়েকজন জলদস্যু তাদের ওপর আক্রমণ করেছে। সব উপহারসামগ্রী তারা চুরি করে নিয়ে গেছে। সাথে মহিলাদেরকেও বন্দি করেছে।’

এরপর হাজ্জাজ যখন শান্ত হলেন তখন তিনি সিন্ধুর রাজা দাহিরের কাছে মুসললিম মহিলাদের মুক্তির দাবি জানিয়ে একটি চিঠি লিখলেন। কিন্তু সিন্ধুর রাজা তাদেরকে মুক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানালো। সে হাজ্জাজকে চিঠির মাধ্যমে জানালো যে, তারা কুখ্যাত চোরদের সাথে ধরা পড়েছে। সে তাদেরকে মুক্তি দিতে পারবে না। তার জবাবটা হাজ্জাজের পছন্দ হলো না। তাই তিনি এই জলদস্যুদেরকে কঠোরহস্তে শায়েস্তা করার এবং মুসলমানদের সম্মানকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি সেনাসদস্যদেরকে প্রেরণ করলেন জলদস্যুদের সাথে যুদ্ধ করতে। কিন্তু তারা সিন্ধু গিয়ে পরাজিত হলো। এরপর অন্য একটি সেনাদলকে তিনি প্রেরণ করলেন। তারাও পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হলো। এবারো পরাজিত হওয়ার পর তিনি বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন। একটি সেনাদল এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে, যেন শত্রুদের তারা কঠোরহস্তে শায়েস্তা করতে পারে।

সিন্ধু অঞ্চল জয়, সেখানে ইসলাম প্রচার ও সাধারণ মানুষকে ওই  অঞ্চলের গভর্নরের অন্যায় থেকে রক্ষা করার লক্ষে তিনি বিশাল এক সেনাদল প্রস্তুত করলেন। পাশাপাশি তিনি ইসলামী রাষ্ট্র এবং বাণিজ্য পথের সীমানাও সুরক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। হাজ্জাজের সেনাবাহিনী প্রস্তুত এবং  কয়েক হাজার অভিজ্ঞ ও সাহসী সৈন্য নিয়োগের জন্য কয়েক মাস সময় লেগেছিল। তিনি তাদেরকে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র ও তাদের অভিযানের জন্য পর্যাপ্ত খাবার দিয়ে সজ্জিত করেছিলেন। সেনাবাহিনী প্রস্তুত করার পর তিনি এমন একজনকে খুঁজছিলেন যিনি সুন্দরভাবে এ মিশনটি বাস্তবায়ন করতে পারবে। এরপর তিনি এ মিশন বাস্তবায়নের জন্য  সেনাপতি হিসেবে তার ভাতিজা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে নির্বাচন করলেন। তার পূর্ণ নাম ইমাদউদ্দিন মুহাম্মদ বিন কাসিম আসসাকাফী। তিনি ইতিহাসে মুহাম্মদ বিন কাসিম নামে পরিচিত।

মুহাম্মদ বিন কাসিম আনুমানিক ৬৯৫ সালে বর্তমান সৌদি আরবের তায়েফের সাকীফ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই তিনি পিতৃহারা হোন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি সৈনিক পদে যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তার চাচাতো বোন ও হাজ্জাজ কন্যা যুবাইদাকে বিবাহ করেন। ৭১১ সালে তিনি যখন এ অভিযান পরিচালনার জন্য মনোনীত হোন তখন তার বয়স মাত্র ১৬ বৎসর। তিনি ছিলেন, একজন উমাইয়া সেনাপতি। তিনি পর্যায়ক্রমে সিন্ধু নদসহ সিন্ধু ও মুলতান অঞ্চল  জয় করে উমাইয়া খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি ছিলেন একজন উদীয়মান তারকা। যুদ্ধ ক্ষেত্রে তার শক্তি, সাহসিকতা, সামরিক দক্ষতা ও নিপুণতার জন্য সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। সৈন্যদেরকে জয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার নেতৃত্ব দেওয়ার মতো ক্ষমতা ছিল তার। তিনি যুদ্ধ ক্ষেত্রে  ধৈর্যশীল ও অবিচল ছিলেন। এ সিন্ধুগামী সেনাদলের জন্য সেনাপতি হিসেবে মুহাম্মদ বিন কাসিমকে নির্বাচন করা হয়েছে; এ সংবাদ যখন সেনাবাহিনী জানতে পারল তখন তারা নিশ্চিত হয়ে গেল যে, নিশ্চয় এবার বিজয় তাদের হাতের মুঠোয়। ইনশাআল্লাহ! এবার আল্লাহ তাদেরকে বিজয়ী করবেন।

তরুণ সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন সেনাবাহিনী প্রস্তুতকরণ জরিপ, সামরিক পরিকল্পনা নির্ধারণ, শত্রুদের অবস্থান অনুসন্ধান, তাদের শক্তি ও দুর্বলতার বিষয়গুলো জানতে পারলেন এবং নিশ্চিত হলেন যে সবকিছু প্রস্তুত রয়েছে, তখন সেনাদলকে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন। সেনাবাহিনী পরিপূর্ণ প্রস্তুতি ও ভালোভাবে সজ্জিত হয়ে আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে তাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেল। তারা যখন মাকরান নামক স্থানে পৌঁছল সেখানে কয়েকদিনের জন্য বিশ্রাম নিল। সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম তার সৈন্যবাহিনীকে দুদলে বিভক্ত করে ফেললেন। এক দল সমুদ্রপথে আরেক দল স্থলপথে। সেখান থেকে যাত্রা শুরু করল।

মুহাম্মদ বিন কাসিম দেবল শহরে পৌঁছে পুরো শহর অবরোধ করে ফেললেন। সময় তখন ৮৯ হিজরীর রবিউল আওয়াল। ঠিক ওই সময়েই  মুসলিম সৈন্য, যুদ্ধাস্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীসহ একটি জাহাজ তারা দেবলে (তারা যেখানে অবস্থান করছিল সেই জায়গা) পৌঁছে গেল। সেখানে পৌঁছে পরিপূর্ণভাবে শহরকে অবরোধ করে ফেলে তারা। অল্প সময়েই তার হাতে দেবলের পতন ঘটে।  সিন্ধুর রাজা দাহিরের সৈন্যরা অবস্থা বেগতিক দেখে শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এরপর পরিপূর্ণভাবে মুসলমান সৈন্যগণ শহরে প্রবেশ করে। শহরের লোকদের সাথে ন্যায়বিচার ও সদয় আচরণ শুরু করে। মুহাম্মদ ইবনে কাসিম তখন শহরে মুসলমানদের জন্য একটি শিবির স্থাপনের পরিকল্পনা করেন এবং তিনি সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনি এই শহরটিকে মুসলমানদের জন্য সমুদ্র ঘাঁটি হিসাবে প্রস্তুত করেছিলেন।

দেবল শহরটি স্থিতিশীল হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি কিছু ইসলামিক রক্ষী বাহিনী সেখানে রেখে যান। তারপরে তিনি তাঁর সেনাবাহিনীকে আরো নগর জয় করার জন্য নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। দেবলের পর তার হাতে একে একে সিন্ধুর বিভিন্ন শহরের পতন ঘটে। সবকটি যুদ্ধেই তিনি জয়লাভ করেছিলেন। কারণ তিনি কেবলমাত্র সকল মানুষকে দাসত্ব ও অত্যাচার থেকে মুক্ত করার জন্য, ন্যায়বিচার বাস্তবায়নের জন্য এবং শান্তি ও সুরক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য লড়াই করেছিলেন। সিন্ধুবাসীর প্রতি মুহাম্মদ বিন কাসিমের নীতি বহু মানুষকে তার সাথে যোগ দিতে উৎসাহিত করেছিল। তিনি এক এক করে সিন্ধুর সমস্ত অঞ্চল জয় করেছিলেন। সমস্ত সিন্ধু অঞ্চল  ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে না আসা পর্যন্ত।

তিনি দাহিরের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন, যিনি তাকে শহরের ভেতরে টেনে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল। মুহাম্মদ বিন কাসিম তার পরিকল্পনা বুঝে ফেলেছিলেন। তিনি গোপনে তার পরিকল্পনা সাজিয়ে রাজা দাহিরকে অবাক করে দিয়েছিলেন। তিনি তার হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে রাতে ‘মাহরান’ নদী পার হয়েছিলেন। কয়েক ঘণ্টা পর পুরো সেনাবাহিনী অন্যদিক দিয়ে দাহিরের সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়েছিল। সকাল বেলা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। রাজা দাহির হাতির পিঠে আরোহণ করে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছিল।  যুদ্ধ কয়েক ঘণ্টা চলার পর মুসলমানরা বিজয়ী হয়ে যায়। রাজা দাহির নিহত হন এবং তার সৈন্যরা যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যায়।

এই মহান বিজয়ের পরও মুহাম্মদ ইবনে কাসিম সিন্ধুর অন্যান্য অঞ্চল জয় করেছিলেন। তার অঞ্চলগুলোতে ইসলামী আইনকানুন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পুরো অঞ্চলে ন্যায়বিচার ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এজন্য লোকেরা তাকে স্বাগত জানায় এবং তার আনুগত্য শিকার করে। মুসলমানরাও তাদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।মুসলমানদের আচার আচরণ দেখে তখন এই অঞ্চলের মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে। জনসাধারণের পাশাপাশি গভর্নর, নেতা, মন্ত্রীরা এবং বিভিন্ন অঞ্চলের রাজকুমাররাও ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এমনকি সিন্ধুর  রাজা দাহিরের চাচাত ভাই রাজকুমার কাকাহ ইবনে জানদারও ইসলাম গ্রহণ করেছিল। সিন্ধু অভিযান শেষ করে মুহাম্মদ বিন কাসিম ফিরে যান ইরাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তত দিনে দামেস্কে পালাবদল ঘটে ক্ষমতার। সুলাইমান ইবনে আবদুল মালেক ক্ষমতা গ্রহণ করেন। খলিফা ওয়ালিদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে মুহাম্মদ বিন কাসিমকে পাঠানো হয় কারাগারে। বন্দি অবস্থায় মাত্র ২৪ বছর বয়সে মৃত্যু হয় এ মহান বীরের। তিনি ছিলেন এমন একজন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি, যিনি ভারতের প্রথম মুসলিম সেনাপতি এবং ভারতের প্রথম মুসলিম শাসক হিসেবে ভারতীয় মুসলমানদের কাছে আজও চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক

 

Wordbridge School
Link copied!