• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

ঘরে ফিরতে চায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২২, ০৭:১২ পিএম
ঘরে ফিরতে চায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা

ঢাকা : সুযোগ দিলে সন্ত্রাসী জীবন ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায় পার্বত্য জেলার অস্ত্রধারী বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা। এমনকি নেতারাদেরও এমন ইচ্ছে রয়েছে। তবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে বড় বাধা মনে করছেন নিজ সংগঠনকে। কারণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরলে জীবননাশের শঙ্কায় অনেকের ইচ্ছে থাকলেও ফিরতে পারছেন না।

গত ১১ ফেব্রুয়ারি ইউপিডিএফের এক নেতা অস্ত্রসহ সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এমন এক সময় তিনি আত্মসমর্পণ করলেন যখন পাহাড়ি ৫ টি গোষ্ঠীর মধ্যে চলছে আধিপত্যের লড়াই। প্রায় প্রতিদিনই নিজেদের মধ্যে হচ্ছে গোলাগুলি। সম্প্রতি ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীদের গুলিতে সেনাবাহিনীর একজন সদস্যও নিহত হয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ভুল ভাঙছে পাহাড়ি যুবকদের। সশস্ত্র গ্রুপ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান তারা। স্বাভাবিক জীবনের বাইরে গিয়ে গহীন অরণ্যে একদিকে যেমন জীবনের স্বাদ থেকে তারা বঞ্চিত, অন্যদিকে পরিবারের টানও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।  তারা এখন উপলব্ধি করছেন স্বাভাবিক জীবনের। কিন্তু নিজ সংগঠনের সদস্যদের হাতেই বন্দি বা মৃত্যু হতে পারে এমন আশঙ্কাতে ফিরতে পারছে না। এ জন্য সরকারের সহায়তা ও প্রতিশ্রুতি চান।
 
সূত্র মতে, পাহাড়ি সশস্ত্র বিভিন্ন সংগঠনের শতাধিক সদস্য ফিরতে চান স্বাভাবিক জীবনে। যারা শান্তিচুক্তির পরও অস্ত্রহাতে এখনো সশস্ত্র। বর্তমানে আধিপত্য বিস্তার আর চাঁদাবাজির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে নিজেদের মধ্যে হিংসা হানাহানিতে ব্যস্ত।

ইউপিডিএফ নেতার সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ : ইউপিডিএফর বিচার ও সাংগঠনিক পরিচালক আনন্দ চাকমা। গত ১১ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়িতে বিদেশি পিস্তল ও গুলিসহ সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। তিনি খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার মনোরঞ্জন চাকমার ছেলে।

মহালছড়ি সেনা জোনের অধিনায়কের কাছে একটি পিস্তল, ম্যাগাজিন, তিন রাউন্ড গুলিসহ আনন্দ চাকমা আত্মসমপর্ণ করে।

আনন্দ চাকমা জানান, আদর্শহীন ইউপিডিএফর খুন, গুম, অপহরণ, চাঁদাবাজির কারণে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আশায় অস্ত্র সমর্পণ করেছেন। সরকার ঘোষণা দিলে ইউপিডিএফর অনেক নেতাকর্মী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছে। 

আনন্দ চাকমা বলেন, প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ এর কাছে একে-৪৭, এসএমজি, চাইনিজ রাইফেল, এলএমজি, একাশি ও এম-১৬-এর মতো বিপুল ভারী আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে।

রাঙামাটি জেলার নানিয়াচর সার্কেলের বিচার ও সাংগঠনিক শাখার পরিচালক আনন্দ চাকমা জানান, জীবনের ৩০ বছর আমি জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরেছি। 

কিন্তু দুঃখের বিষয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায় ও তাদের উন্নতির যে লক্ষ্য নিয়ে যুবক বয়সে এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছিলাম তা থেকে ইউপিডিএফ সম্পূর্ণভাবে বিচ্যুত। ইউপিডিএফর কোনো নীতি ও আদর্শ নেই। তারা সকলেই চাঁদাবাজি, মানুষকে হয়রানি আর ভয়ভীতি ও অন্যায়-অত্যাচার করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। গুম, খুন, হত্যা ও অপহরণই বর্তমানে তাদের কাজ। আমারও স্ত্রী, এক ছেলে ও ডিগ্রী ৩য় বর্ষে পড়ুয়া একটি মেয়ে রয়েছে। 

এ কারণে অনেক ভেবেচিন্তে অন্যায়ের পথ ছেড়ে সুস্থ, স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ জীবনে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার মতো অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায়। কিন্তু ইউপিডিএফ হত্যার ভয় দেখাচ্ছে। এ জন্য তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারছে না।

আনন্দ চাকমা আরো জানান, জঙ্গলের অস্বাভাবিক জীবন ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনের ফিরে আসায় পরিবারের সদস্যরা আনন্দিত। আমার এক ছেলে সরকারি চাকরি করছে। আমার মেয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। আমিও এই স্বাধীন দেশের উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করে আমার বাকি জীবনটা একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে সুখে শান্তিতে কাটাতে চাই।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, সশস্ত্র ৫ সন্ত্রাসী গ্রুপের সংঘর্ষে আবারো অশান্ত হয়ে উঠেছে তিন পার্বত্য জেলা। 

আধিপত্য বিস্তার নিয়ে প্রায় প্রতিদিন এক গ্রুপের সঙ্গে আরেক গ্রুপের গোলাগুলি হচ্ছে। শান্তিচুক্তির চুক্তির ২৪ বছরে সর্বোচ্চ বরাদ্দে পাল্টে যাওয়া এ অঞ্চলে সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে খুন করেছে আড়াই হাজারের বেশি। ৩০ লাখ অধিবাসী অধ্যুষিত এসব অঞ্চলে পাহাড়ি বাঙালি সবাই এসব সশস্ত্র গ্রুপে জিম্মি। 

মূলত বছরে হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজির আধিপত্য নিয়েই চলছে সংঘাত। আর এসব সংঘাতে রক্তাক্ত জনপদে পরিণত হয়েছে পুরো পাহাড়ি এলাকা।

স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, তিন পার্বত্য এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মূলত পাঁচ সন্ত্রাসী সশস্ত্র সংগঠন। 

এরা হলো জেএসএস, জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ, গণতান্ত্রিক এবং সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে এমএনপি (মগ গণতান্ত্রিক পার্টি)।

স্থানীয় অধিবাসীরা বলছেন, শান্তিচুক্তির ২৪ বছরে সরকারের নানা উন্নয়ন প্রকল্পে পাল্টে যেতে শুরু করেছে এ অঞ্চলের জনপদ। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভাটসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করছে সেনাবাহিনী। মূলত তাদের এ লড়াইয়ে এ জনপদ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।

গোয়েন্দা সূত্রগুলো আরো বলছে, বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলভিত্তিক পাঁচটি উপজাতীয় সংগঠনের হাতে প্রায় ৪ হাজারের মতো আগ্নেয়াস্ত্র মজুত রয়েছে। ধীরে ধীরে এসব সংগঠনে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র। চাঁদাবাজি ও আধিপত্য নিয়ে কোন্দলে মাঝেমধ্যেই গর্জে উঠে ভয়ঙ্কর ওইসব অস্ত্র। 

অস্ত্রের গর্জন ছড়িয়ে শান্তির পাহাড়কে করছে তারা অশান্ত। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ব্যাপক হারে প্রাণ যাচ্ছে ওইসব সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সাধারণ পাহাড়িদের।

২০১৮ সালের ৩ মে আধিপত্যের কোন্দলে ‘ব্রাশফায়ার’ করে জেএসএস (সংস্কার) সমর্থিত নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে হত্যা করে ইউপিডিএফের (মূল) সন্ত্রাসীরা।

পরদিন ৪ মে শক্তিমানের শেষকৃত্যে যোগ দিতে যাওয়ার সময় ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) সভাপতি তপন জ্যোতি চাকমা বর্মাসহ পাঁচজনকে ‘ব্রাশফায়ার’ করে হত্যা করে ইউপিডিএফের (মূল) সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। 

একই বছরের ২ মে ইউপিডিএফের সাবেক সদস্য উজ্জ্বল কান্তি চাকমাকে জেএসএসের (সংস্কার) সশস্ত্র ক্যাডাররা গুলি করে হত্যা করে। 

কয়েকদিন পর ২৮ মে সাজেক থানার করল্লাছড়ি এলাকায় ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) ক্যাডারদের গুলিতে ইউপিডিএফের (মূল) সদস্য স্মৃতি চাকমা, সুশীল চাকমা ও অটল চাকমা নিহত হন। 

এই ধারাবাহিকতায় এখনো মাঝেমধ্যেই রক্ত ঝরে পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে।

এ কারণে পরিস্থিতি বিবেচনায় সেনাবাহিনীর পরিত্যক্ত ক্যাম্পগুলোতে নতুন করে আবারো সেনা মোতায়েন জরুরি বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। 

তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আপাতত পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনীর পরিত্যক্ত ক্যাম্পে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট ‘আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)’ এবং আনসার ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 

গত ১৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে নিরাপত্তা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সশস্ত্রবাহিনী বিভাগকে (এএফডি) নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে পর্যায়ক্রমে পার্বত্য তিন জেলা থেকে সেনাবাহিনীর ৩৩৪টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। 

কিন্তু যে এলাকা থেকেই ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে, সেখানেই সুযোগ নিয়েছে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। আধিপত্য বাড়াতে পরিত্যক্ত সেনা ক্যাম্পগুলো ঘিরেই আস্তানা গড়েছে পার্বত্য অঞ্চলের সশস্ত্র সংগঠনগুলো।

এমন পরিস্থিতিতে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাওয়ার ঘটনা ইতিবাচকভাবেই দেখছেন স্থানীয় অধিবাসীরা। বিষয়টি সরকারের উচ্চমহলের দৃষ্টি আকর্ষণও করেছেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!