• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কোথায় আছেন, কেমন আছেন তাপস বৈশ্য


ক্রীড়া ডেস্ক নভেম্বর ১৮, ২০২১, ০৯:১৯ পিএম
কোথায় আছেন, কেমন আছেন তাপস বৈশ্য

ঢাকা: বাংলাদেশ দলের একসময়কার সাড়া জাগানো ক্রিকেটার তাপস বৈশ্যর কথা মনে আছে তো? হয়তোবা যুগের বিবর্তন ও সময়ের স্রোতে আমাদের কারোরই মনে নেই বাংলাদেশের এক সময়কার সেরা এই ফাস্ট বোলারের কথা। বোলিং এর পাশাপাশি ব্যাট হাতেও ছিলেন কার্যকরী।

বর্তমান সময়ে ক্রিকেট ভক্তরা তার কথা খুব একটা মনে না করলেও ক্যারিয়ার চলাকালীন সময়ে ঠিকই আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলেন তাপস বৈশ্য।

একটু খুঁজে দেখলে এখনো তার ভক্ত সংখ্যা কম হবে না। তাদের জন্যই সাবেক এই পেসারকে নিয়ে আজকের আয়োজন। শুরুতেই প্রশ্ন আসতে পারে তিনি এখন কোথায়?

২০১৬ সালের জুলাই থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নিউইয়র্কে বাস করছেন তাপস। তাপস ও তার স্ত্রীর প্রথম সন্তানই ছিল ছেলে। এরপর টানা দুই বার তাদের ঘরের লক্ষ্মী হয়ে এল দুই মেয়ে সন্তান। ২১ টেস্ট ৩৬ উইকেট আর ৫৬ ওয়ানডেতে ৫৯ উইকেট পাওয়া এই পেসারের বর্তমান ব্যস্ততা নিজের একাডেমি নিয়ে। ভারতীয় ও পাকিস্তানি প্রবাসীদের সন্তানেরা ক্রিকেটের দীক্ষা নিতে আসেন বাংলাদেশের এই সাবেক ক্রিকেটারের কাছে। তবে তাপস এতে পুরোপুরি তৃপ্ত নন। তার স্বপ্ন আরও বড়। 

মাত্র ৭৭টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে টাইগার জার্সি গায়ে জড়িয়েও নেই কোনো আক্ষেপ। বরং ক্যারিয়ারের ৭২০ রান ও ৯৫ উইকেটের জন্য গর্ব আছে তার। ১৯৮২ সালে জন্ম নেওয়া এই সিলেটি ক্রিকেটার পরিবার নিয়ে এখন আছেন সুদূর আমেরিকায়। সেখানেও আছেন ক্রিকেট নিয়ে। খুলেছেন ক্রিকেট একাডেমি। চেষ্টা করছেন নিজের অভিজ্ঞতা নতুনদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থান নিয়ে গর্ব করা তাপস গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন আরও অনেক কথা।

নিজের ক্রিকেটে আসার গল্প, ক্যারিয়ারের গল্প, সর্বোপরি একজন ক্রিকেটার তাপসের গল্প... 

টেপ টেনিস বল দিয়ে তাপসের ক্যারিয়ার শুরু। একদিন স্থানীয় কোচরা ক্রিকেট বল ধরিয়ে দেন। স্কুল ক্রিকেটে খেলার সময় ঢাকা থেকে কয়েকজন কোচ দেখতে গিয়েছিলেন তাকে। তাপসের রান আপ আর বোলিং দেখে তারা ঢাকায় যাওয়ার কথা বলেছিলেন। তখন পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তাপস। তখন পড়তেন এসএসসিতে।

পরীক্ষার পর প্রস্তাব পান ঢাকায় গিয়ে খেলার। ঢাকাতে এসেই যোগ দেন নির্মাণ স্কুল ক্রিকেট টিমে। দলের দায়িত্বে ছিলেন দীপু রায়। এরপরই তাপসের ভাগ্য বদলে গেলো। তখন থেকে একটু বুঝার চেষ্টা করেন এবং শেখার চেষ্টা, উপরে যাওয়ার একটা প্রবল চেষ্টা করতে থাকেন। ধানমন্ডির মাঠে অনুশীলন করতেন। অনেক সিনিয়ররা আসতো; তাদের দেখে, বড় বড় খেলোয়াড়কে দেখে, আবাহনীর দলকে দেখে নিজের ভেতর একটা ইচ্ছা পোষণ করেন ক্রিকেটার হবেন।

নির্মাণ স্কুল থেকে অনূর্ধ্ব-১৯ ক্যাম্পে চলে যান। ২০০০ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ ক্যাম্পে ব্যস্ত ছিলেন তাপস। এর মাঝে ইস্কাটনের হয়ে কয়েকটি প্রথম বিভাগের ম্যাচ খেলেছেন। পরের বছরও প্রথম বিভাগে খেলার কথা ছিল লালমাটিয়ার হয়ে। আবার জাতীয় লিগের ম্যাচও শুরু হয়েছিলো। কিন্তু হঠাৎ মোহামেডান জানতে পারে একটা ছেলে আছে...বোলিংয়ে ধার আছে, গতিও আছে। ওই ক্লাবে যোগ দেওয়ার পরই জীবন পাল্টে যায় তাপসের। পেশাদার ক্রিকেটারে পরিণত হন তিনি। 

৮০,০০০ টাকায় ক্লাবটিতে চুক্তি সই করেন। মোহামেডানের মতো দলের ক্রিকেটার হতে পেরেছেন। এটাকেই বড় করে দেখতেন তাপস। প্রথম বিভাগে লালমাটিয়া ক্লাবে ওই বছরই ৪০ হাজার টাকার চুক্তি করেন। নাসু, প্রিন্সরা মোহামেডানের হয়ে খেলতেন। মোহামেডান ক্লাবের নাম তো তখন আসলে ক্রেজ ছিল। আবাহনী-মোহামেডান তখন বিশাল ব্যাপার। ওই সময়ে তাদের দাপটে লালমাটিয়া তাপসকে ধরে রাখতে পারেনি। ক্লাবের সঙ্গে সমঝোতা হয়। লালমাটিয়ার টাকা ফেরত দিয়ে, মোহামেডান আরও ৪০ হাজার বাড়িয়ে ৮০ হাজার দিয়ে চুক্তি করে তাপসের সঙ্গে।

খেলোয়াড়ি জীবনে তাপসের ভালো লাগত শচীনের খেলা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের অনেকগুলা টেস্ট ম্যাচ দেখতেন রাত জেগে। ওই সময় খেলা গুলো দেখে অনুপ্রাণিত হতেন। সিলেটের স্কুলের খেলাও দেখতে যেতেন তিনি। তাপস যখন খেলা শুরু করেন তখন দলে ছিলেন শান্ত, বাবুদের মতো ক্রিকেটাররা। এছাড়া মঞ্জুরাও ছিলো। তাদেরকে টার্গেট করে এগিয়ে যেতেন তাপস। পরিকল্পনা করতেন তাদেরকে টপকে যাবেন এক এক করে। এভাবেই টার্গেট সেট করেন। ওয়ান বাই ওয়ান একজনকে বিট করে দলে ঢুকবেন, আরো উপরে যাবেন এই জিনিসটা মাথায় কাজ করতো তাপসের।

এরপর তো ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন। এক সময় পেলেন আন্তর্জাতিক ক্যাপ। সময়টা ২০০২ সাল। বিকেএসপিতে ক্যাম্পে ছিলেন তাপস। হুট করে ফোন পেলেন শ্রীলঙ্কায় দলের সঙ্গে যেতে হবে। বুঝে উঠতে পারছিলেন না কি করবেন আর কি করবেন না। কারণ দল তখন চলে গেছে, ঢাকায় তিনি একা। সুযোগ পেয়েও যাচ্ছি যাচ্ছি করেও সুযোগ দেওয়া হচ্ছিল না তাপসকে। জাতীয় দলের স্ট্যান্ডবাই হয়েও ‘এ’ দলে সুযোগ পাননি। অনেক কিছু হওয়ার পর ভাবনা ছেড়ে দেন তাপস। এরপর হুট করেই ওই ডাকটা আসল। বলা হলো, ফ্লাইট কালকেই। সেখানে গিয়ে আঁতকে উঠলেন তাপস। প্রথম শ্রেণির অনেক ম্যাচ খেলেছেন কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের যে পরিবেশ, আবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে; এত গরম, এত চাপ। এসব নিয়ে খেলা শুরু করেন। প্রথম উইকেটের দেখাও পান জীহান মোবাররককে শিকার করে। প্রথম উইকেটের জন্য যে আপিল করেছিলেন আর সেটাতে সাড়া দিয়ে আউট দেন ডেভিড শেফার্ড।

ওয়ানডেতেও তাপসের অভিষেক শ্রীলঙ্কার সাথে। প্রথম উইকেট সনাৎ জয়সুরিয়ার। তাপসের সেই বলটা দ্রুতগতির ছিলো। টাইমিংয়ে গড়বড় করেছিলেন জয়সুরিয়া। টপ এজ হয়ে যায়। ক্যাচ ধরেন দুর্জয়। ম্যাচটা বাংলাদেশের পুরো দৃশ্যপট পাল্টে দেয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটে একটা বড় পরিবর্তন দেখা দেয়। অনেক উত্থান হয়েছে ওই সময়ে। নতুন নতুন খেলোয়াড় এসেছে। দলের পরিবেশ পরিবর্তন হয়েছে। ক্রিকেটের অবকাঠামোতে পরিবর্তন হয়। তারপর জেতা শুরু করায় মানসিকতাও বদলে যায় টইগারদের।  

এরপর তো অস্ট্রেলিয়াকে প্রথমবারের মতো হারিয়ে দেয় টাইগাররা। টাইগাররা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে কাউকে হারানোর সামর্থ্য আছে তাদের। ওই ম্যাচে রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্ক, ড্যামিয়েন মার্টিনের মতো তারকাদের উইকেট শিকার করেছিলেন তাপস। তারপর আবার ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ। টাইগারদের শুধু ম্যান টু ম্যান ব্যক্তিগত টার্গেট দেওয়া হতো। শুধু সেটা ফলো করার চেষ্টা করতেন। খুব চুপচাপ থাকতেন। ম্যাচটা কে ফিনিশ করবে, কে জিতিয়ে আসবে ওরকম কোনো পরিকল্পনা থাকত না। এসবের মাঝেই ভারতকে হারানোর ম্যাচে অবদান চিল তাপসেরও। ক্যারিয়ারে তাপসের কাছের মানুষ ছিলেন মাশরাফি। অনেক স্মৃতি আছে দুজনের। তাপসও বিশ্বাস করেন তিনি ম্যাশের খুব ভালো পার্টনার ছিলেন। দুইজনের বোলিং জুটিটা দীর্ঘদিন ছিল।দুজন দুজনের থেকে শিখতেন।  

একদিন নেটে ব্যাটসম্যান ছিলেন হান্নান সরকার। ওর নেটের ব্যাটসম্যানের নাম মনে নেই। ওই সময়ে আমি একদিক থেকে ব্যাটসম্যানকে বিট করছি। ও ঠিক তাই করছে। দুই বোলারকে সেদিন দলের কেউ খেলতেই পারছিল না। আসলে ও আর আমি সবসময় গল্প করতাম, জানতাম, শিখতাম একজন আরেকজনের কাছ থেকে। মাশরাফিকে অনেক মিস করেন তাপস। দুজনের জুটির সময়ও অনেক ইনজুরিতে ছিলেন মাশরাফি। ওইসময় তাপসকে বাঙ্গি মামা বলে ডাকতেন ম্যাশ। আর তাপস ম্যাশকে ডাকতেন পাগলা বলে। 

ক্যারিয়ারের শেষ ৩/৪ বছর অনেক ভুগেছেন তাপস। ২০১৬ মৌসুমটা কষ্ট ও দূর্ভাগ্যকে সঙ্গী করে কাটান। আবাহনীর হয়ে ওই মৌসুমে পা ভাঙেন প্রথম দিনই। পরে ফিরে আসাটা অনেক কঠিন হয়ে যায়। শেষ ৩/৪ বছর অনেক সমস্যার মধ্যেই ছিলেন। খেলার কারণে জীবন পরিবর্তন হয়েছে তাপসের। রাত-দিন ২৪ ঘন্টাই ছিল ক্রিকেট। আজ এই দেশে, কালকে ওই দেশে খেলেছেন।  

পরিবার থেকে শুরুর দিকে তাপসের বড় ভাই তাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। তাপসকে ঢাকায় আসার টাকা দিয়েছিলেন খালেদ মাহমুদ সুজন। ১৯৯৮-৯৯ এর দিকে ঢাকায় আসা কিন্তু অত সহজ ছিলো না। মোহামেডান থেকে খেলা শুরু করে নিজের যাবতীয় খরচ নিজেই চালানো শুরু করেন। ২০০৪-০৫ থেকে ফ্যামিলিকে কন্ট্রিবিউট করা শুরু করেন তাপস। 

তবে বর্তমান বাংলাদেশকে নিয়ে বিশাল খুশি তাপস। নিয়মিত বাংলাদেশের ক্রিকেটের খোঁজ-খবর রাখেন। তাপস বর্তমান বাংলাদেশ নিয়ে এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে, বাংলাদেশ একদিন বিশ্বকাপ জিতবে বলেও মনে করেন তিনি। ক্যারিয়ারে তাপসের সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্ত প্রথম টেস্ট জয়।

তৎকালীন কোচরাও তাপসকে অনেক সাহায্য করেন। তাপস যখন খেলছিলেন, তখন টাইগারদের দলপতি ছিলেন হাবিবুল বাশার। সবার সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করতেন বাশার। খুব চুপচাপ থাকতেন। আর সবসময় কম টার্গেট দিয়ে কাজটা আদায় করার চেষ্টা করতেন। হাবিবুল বাশারের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণটাই মূলত তাপসের ভালো খেলার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।  

দল বিপদে পড়লে তাপস আর মাশরাফিকে নিয়ে পরিকল্পনা সাজানো হত। ওই সময় টিম মিটিং বা ব্যক্তিগতভাবে হাবিবুল বাশার তাপসকে বলতেন, ‘‘তাপস তোকে কিন্তু স্লগ ওভারে বল করতে হবে। তুই স্লগ ওভারে আমার সেরা বোলার।’’ একজন অধিনায়ক যখন এমন কথা বলবে এটা বোলারের জন্য বিশাল প্রাপ্তি। আর এটাই ভালো করার স্পিরিট বাড়িয়ে দেয় তাপসের।

ক্রিকেটের কারণেই তিনি তাপস বৈশ্য। ক্লাস ৯ বা ১০ থাকতে টেপ টেনিস বলে খেলতেন তাপস। খেলার বাইরে পড়ার টেবিলে বেশ মনোযোগ থাকতো তাপসের। ওই সময় রাত ৯/১০টার সময়ও ক্রিকেট পার্টনাররা এসে বলতেন কালকে খেলা। ক্রিকেট ছাড়া কিছু ভাবতে পারেননা তিনি।

এদিকে নিজের ছেলেকে ক্রিকেটার বানানোর স্বপ্ন থাকলেও সব ইচ্ছে যে পূরণ হবে না সেটাও মানেন। যে জায়গায় গেছেন, সেখানে ক্রিকেট খেলার সুযোগও অনেক কম। শুধু তাই নয় তাপসের স্ত্রীও একটু ভীতু এমনকি খেলাধুলাকেও ভয় পান। সব মিলিয়ে অসংখ্য ক্রিকেট ভক্তের হৃদয়ে ঠাঁই পাওয়া সাবেক এই ক্রিকেটার কখনো মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাবেন না এমন প্রত্যাশা করাই যায়।

সোনালীনিউজ/এআর

Wordbridge School
Link copied!