• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দূরের দৃষ্টি হারাচ্ছে শিশুরা


নিউজ ডেস্ক জুন ১৬, ২০২১, ০৪:৩৯ পিএম
দূরের দৃষ্টি হারাচ্ছে শিশুরা

ঢাকা : লকডাউনে স্কুল বন্ধ, বাইরে যাওয়া বন্ধ। শিশু ঘরে বসে করবেটা কী! কাজেই হাতে ধরিয়ে দাও মোবাইল কিংবা ল্যাপটপ। যারা আগে ফোন থেকে দূরে ছিল তারাও হয়ে গেলো আসক্ত। খেলার সময়, খাওয়ার আগে, অনলাইন ক্লাস, ঘুমের সময়; ক্ষণে ক্ষণে চাই মোবাইল। আর এতে করে মাইয়োপিয়া বা চোখের ক্ষীণ দৃষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।  

চিকিৎসকরা বলছেন, গত প্রায় এক বছরে শিশুরা বাড়িতে বসে থেকেছে। সারাক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। দূরের জিনিস দেখেনি; ফলে তাদের দূরের দৃষ্টিশক্তি ঠিকমতো তৈরিই হচ্ছে না। দৃষ্টিশক্তি একদিনে তৈরি হয় না; আট বছর পর্যন্ত শিশুদের চোখের গঠনগত পরিবর্তন হতে থাকে। ফলে এই বয়সের শিশুরা দূরের জিনিস না দেখতে দেখতে, দূরের দৃষ্টিশক্তিই হারিয়ে ফেলছে। বড় হওয়ার পরেও তাদের এই সমস্যা কাটবে না।   

আগেও ডিভাইস ব্যবহার করতো শিশুরা। কিন্তু তাতে একটি নিয়ম ছিল, রুটিন ছিল। মাঝে শিশু স্কুলে গিয়েছে, মা-বাবার সঙ্গে বাইরে গিয়েছে, নাচের স্কুল-গানের স্কুল, মার্শাল আর্ট, ছবি আঁকা, বন্ধুদের জন্মদিন- কত কী ছিল। এখন কিছুই নেই; ক্লাসও হচ্ছে অনলাইনে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকো মনিটরে। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতেও চালু করো মেসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপ কিংবা জুম। বিনোদন মানে অনলাইন গেমস। এই স্ক্রিন নির্ভরতার কারণে শিশুদের জীবনযাত্রায় এসেছে পরিবর্তন। এরই প্রভাবে নেতিবাচক সাড়া দিতে শুরু করেছে চোখ।

শিশু চক্ষুবিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাকালে কয়েকটি কারণে শিশুদের মধ্যে এ সমস্যা বাড়তে পারে- ১. স্কুল বন্ধ থাকায় ঘরে থাকা, ২. দিনের আলো চোখে কম পড়া, ৩. অনলাইনে বিরতিহীনভাবে দীর্ঘ সময় ক্লাস করা ও ৪. মোবাইলের মতো ডিজিটাল ডিভাইসের পর্দায় (স্ক্রিনে) সময় বেশি দেয়া। তারা বলছেন, শিশুদের যে সময় দূরের দৃষ্টি তৈরি হওয়ার কথা, সে সময়ই তারা মোবাইল ফোনের কিংবা ট্যাবের স্ক্রিনে দৃষ্টিকে আটকে রাখছে। যে কারণে দূরের দৃষ্টি প্রসারিত হতে পারছে না।

মাহতাব ন্যাশনাল ব্যাংক পাবলিক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। তার মা খায়রুন্নাহার নিপু জানালেন, সায়হানের আগের রুটিন নষ্ট হয়েছে, মোবাইলের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে অনেক। আগে রুটিনের ভেতরে ছিল। সেটা নেই। এখন রাতে ঘুমায় দেরি করে, সকালে উঠে দেরি করে। উঠেই মোবাইল খোঁজে। কিছু বললে বলে মোবাইলে পড়ালেখা করবে।

কিন্তু পড়ার জন্য মোবাইলে এত সময় কেন থাকতে হবে মন্তব্য করে নিপু বলেন, এটা একটা বিরাট সমস্যা। আর আমরা সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকায় মনিটরিংও করতে পারছি না।

করোনাকালে শিশুদের চোখের সমস্যা বাড়ার প্রবণতার বিষয়টি জানা যায় হাসপাতালে ঘুরে। অনেক অভিভাবক চোখের সমস্যায় আক্রান্ত সন্তানদের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন। ৮ মে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বহির্বিভাগে আট বছরের সায়মাকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন মা শামীমা আক্তার। সায়মা অনলাইনে ক্লাস করে। তার মা বলেন, সায়মা মাথাব্যথা ও চোখব্যথায় ভুগছে।

ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের বহির্বিভাগে আসা শিশু রোগীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশি দৃষ্টিত্রুটি নিয়ে আসে বলে জানান হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. কাজী সাযযাদ ইফতেখার। তিনি বলেন, এই শিশুদের মধ্যে শহরের শিশুরাই বেশি। বাইরে কম যাওয়ার কারণে তাদের দূরে দেখার দৃষ্টির ক্ষমতা কমে যায়।

ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল জানিয়েছে, সেখানকার বহির্বিভাগে এ বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় ২১ হাজার শিশুকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ২৩৩টি শিশু চিকিৎসা নিয়েছে। ২০২০ সালে সংখ্যাটি ছিল ৬১ হাজার, যা আগের বছরের চেয়ে ৩৫ হাজার কম।

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেকর্ড বই ঘেঁটে দেখা যায়, এ বছরের প্রথম ৪ মাসে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার শিশুর চোখের চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। ২০২০ সালে সংখ্যাটি সাড়ে ৪৪ হাজার ছিল, যা আগের বছরের চেয়ে কম। চিকিৎসকেরা বলছেন, করোনাকালে খুব জরুরি না হলে কেউ হাসপাতালে আসেনি। এটাই রোগী কমার কারণ।

তবে করোনা প্রাদুর্ভাবে আগের চেয়ে বেশি শিশু রোগী পাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিট্রিও-রেটিনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তারিক রেজা আলী। তিনি বলেন, কোনোভাবেই শিশু যেন একনাগাড়ে কম্পিউটারের সামনে বা কোনো ডিভাইসের সামনে না থাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিউটের অধ্যাপক ডা. এনাম আবেদিন বলেন, ‘করোনার কারণে এখন তো অভিভাবকরা শিশুদের নিয়ে খুব একটা বের হচ্ছেন না। খুব দরকার না হলে হাসপাতালে আসেন না। ফলে চোখের যে ক্ষতিগুলো সেটা এখন আমরা ওভাবে বুঝতে পারছি না। এটা তো দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা, আরো বছরখানে গেলে শিশুদের যখন চোখে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেবে তখন আমরা বুঝতে পারব করোনাকালীন সময়ে মোবাইল-ল্যাপটপের সামনে দীর্ঘক্ষন বসে থেকে বাচ্চাদের কি পরিমান ক্ষতি হয়েছে।’

শিশুদের চোখের সমস্যা স্থায়ী হয়ে যাওয়ার কারণ সঠিক সময়ে তাদের চোখ বা দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা করা হয় না। শিশুদের দৃষ্টিশক্তি কম থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে যতক্ষণ তারা কথা না বলে বোঝাতে পারছে ততক্ষণ তাদের অভিভাবকরা বুঝতেই পারেন না তার শিশুর চোখের দৃষ্টিশক্তি কতটা।

শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের দুর্বল চোখ সারিয়ে তুলে তাদের দৃষ্টিশক্তি স্বচ্ছ বা স্পষ্ট ফিরিয়ে আনার জন্য সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা করাতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক পাওয়ারের চশমা ব্যবহার, সেইসঙ্গে আই প্যাচ ও চোখের ড্রপ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে তাহলে শিশু তার দুর্বল চোখের দৃষ্টিশক্তি স্পষ্ট ভাবে সারিয়ে নিতে পারবে।

শিশুরা যাতে এ সমস্যায় না পড়ে সেজন্য কিছু পরামর্শও দিয়েছেন চিকিৎসকররা। ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের শিশু চক্ষুরোগ ও স্কুইন্ট (ট্যারা) বিভাগের প্রধান ডা. মো. মোস্তফা হোসেন বলেন, এই সময়ে অনলাইন ক্লাস যেহেতু বন্ধ করা যাবে না, তাই ক্লাসের পর যথাসম্ভব ডিজিটাল ডিভাইস বর্জন করতে হবে। এছাড়া ডিভাইস থেকে দূরে শরীর সোজা রেখে যথাযথভাবে বসতে হবে।

মায়োপিয়ার হাত থেকে বাঁচার উপায় হলো, যেকোনো কাজ করার সময় মাঝে মাঝেই একটু দূরের দিকে তাকানো। এটা অভ্যাস করে ফেলতে হবে৷। খুব মন দিয়ে মোবাইল বা ট্যাবলেটে কাজ করার সময়ও মাঝে মাঝেই দূরের দিকে তাকাতে হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!