• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
ফিরে দেখা ২০১৬

প্রত্যাশা অনুযায়ী ঘুরে দাঁড়ায়নি বিএনপি


নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ১, ২০১৭, ১২:০৭ পিএম
প্রত্যাশা অনুযায়ী ঘুরে দাঁড়ায়নি বিএনপি

দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থেকে সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে বিএনপি। তবে সদ্য বিদায়ী বছরের ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ কাউন্সিল করে এই বিপর্যয় কিছুটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে দলটি। কাউন্সিলের পর ৯ মাস পার হলেও নীতিনির্ধারণী ফোরামের ৩টি পদই শূন্য আছে। এই শূন্য পদগুলো পূরণে সমূহ-সম্ভাবনা সম্পর্কে অজ্ঞাত নেতারা। কাউন্সিলের তিন মাস পর কমিটি গঠিত হলেও দেখতে হয়েছে অসংখ্য পরীক্ষিত নেতার দলত্যাগ। একইসঙ্গে হাত ধরাধরি করে হেঁটেছে মামলা ও আদালতে হাজিরা দেওয়ার বিষয়টিও। পুরো বছরেই সকাল-দুপুর ও বিকাল আদালতে দৌঁড়াতে হয়েছে প্রায় সব নেতাকে। দলের ভেতরে আলোচনা আছে, যেকোনও সময় গ্রেফতার হতে পারেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও।

বছরের শেষ দিকে এসে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেও হারতে হয়েছে বিএনপির প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানকে। নির্বাচনের দিন বিকাল পর্যন্ত সুষ্ঠু বললেও দলের মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী রাতে জানালেন, ‘ভোটগণনায় সমস্যা ছিল।’ এক সপ্তাহ পর দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া অভিযোগ করলেন, ‘নাসিক নির্বাচন ওপরে ফিটফাট, ভেতরে ষড়যন্ত্র ছিল।’ তবে এর আগে নভেম্বরে নির্বাচন কমিশন গঠন ইস্যুতে রাষ্ট্রপতিকে উদ্যোগ নিতে আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে সামনে আসে বিএনপি।

গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় খালেদা জিয়ার জাতীয় ঐক্যের ডাক এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে ১৩ দফা প্রস্তাব বিএনপিকে আলোচনায় রাখে বেশ কিছুদিন। বিদায়ী বছরটা বিএনপির শুরু হয় ৫ জানুয়ারির প্রতিবাদ সমাবেশ দিয়ে। এরপর সারা বছর আর মাঠে নামতে পারেনি দলটি। নানা দিবসে সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করলেও প্রশাসনের অনুমতির অভাবে তা শেষ পর্যন্ত মাঠে মারা যায়। তবে সারা বছর ঘরোয়া অনুষ্ঠানে সরকারবিরোধী নানা হুংকারের কমতি না থাকলেও রাজনীতির মাঠ ছিল শান্ত।

গোটা বছরে বিএনপির অর্জন বলতে দীর্ঘদিন পর দলের জাতীয় কাউন্সিল করতে পারা, আর কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা। এর মধ্য দিয়ে দল পেয়েছে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব। অনেকের প্রত্যাশা ছিল কাউন্সিলের পর ঘুরে দাঁড়াতে পারে রাজনীতির মাঠে কোণঠাসা বিএনপি। কিন্তু গোটা বছরে দেশের ৭৫টি সাংগঠনিক ইউনিটের অর্ধেক জায়গায়ও নতুন নেতৃত্ব আনা সম্ভব হয়নি। ফলে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে তেমন সুবিধা করতে পারেনি দলটি।

খোলা জায়গায় সমাবেশ করতে না পারলেও বিভিন্ন সভা-সেমিনার-গোলটেবিল আর টেলিভিশনের টক শোতে সরব ছিলেন দলের অনেক নেতা। আর দলের বক্তব্য নিয়মিত মিডিয়ায় এসেছে নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে। দলের কার্যক্রম হয়ে পড়ে সংবাদ সম্মেলন নির্ভর। বিদায়ী বছরে দলটির জন্য বড় ধাক্কা ছিল মানি লন্ডারিং মামলায় সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাজা। দলের নতুন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর সঙ্গে ইসরায়েলের কথিত মোসাদের এক কর্মকর্তার বৈঠকের খবরও বেশ চাপে ফেলে বিএনপিকে। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিভিন্ন মামলায় আদালতে হাজিরা, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি- এ নিয়ে বছরজুড়ে টেনশন গেছে দলের ভেতরে।

স্থপতি লুই আই কানের করা জাতীয় সংসদ ভবনের মূল নকশা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা এবং চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবর সরানো হবে বলে সরকারি দলের নেতাদের বক্তব্য বছরের শেষদিকে বিএনপিতে আরেক উদ্বেগ ছড়ায়। এমন অবস্থায় সামনের বছর মাঠের আন্দোলনে ঘুরে দাঁড়ানোকেই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন দলের নেতাকর্মীরা।

অধরা থেকে গেল ঘুরে দাঁড়ানোর ঘোষণা : ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ কাউন্সিল করে বিএনপি। এর সাড়ে চার মাস পর ৫৯২ সদস্যের ঢাউস কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটি নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ খুব বেশি না হলেও এত বড় কমিটি করায় দলের ভেতরে-বাইরে নানা সমালোচনা হয়েছে।  তবে সম্মেলনের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর যে প্রত্যয় ঘোষণা ছিল দলের, সেটি অধরাই থেকে গেল। ‘ঢাউস’ কমিটিও দলকে বিদায়ী বছরে কোনো আশার আলো দেখাতে পারেনি।

আলোর মুখ দেখেনি জাতীয় ঐক্যের ডাক : গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর ৩ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে দলমত-নির্বিশেষে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু দলের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেননি বিএনপি-প্রধান।

তবে ১৩ জুলাই বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট এবং ১৪ জুলাই বিশিষ্টজনদের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন খালেদা জিয়া। জোটের বৈঠকে শরিক দলের নেতারা দ্রুত অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরুর আহ্বান জানান। সে অনুযায়ী বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু তারা ঐক্যের জন্য জামায়াতের সঙ্গে জোট ছাড়ার তাগিদ দেন। পরে বিএনপির পক্ষ থেকে এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় ঐক্যের পালে হাওয়া লাগেনি। ভেস্তে যায় খালেদা জিয়ার জাতীয় ঐক্যের ডাক।

তারেকের সাজা : দায়ী বছরে বিএনপির বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাজার ঘটনা। তবে বিএনপি দাবি করে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তারেককে সাজা দেয়া হয়েছে। গত ২১ জুলাই মুদ্রা পাচার মামলায় নিু আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড ও ২০ কোটি টাকার অর্থদণ্ড দেন হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে তারেকের বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সাত বছরের কারাদণ্ডও বহাল রাখা হয়েছে। তবে তাকে বিচারিক আদালতের দেয়া ৪০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড পরিবর্তন করে ২০ কোটি টাকা করা হয়।

মোসাদের সঙ্গে আসলামের যোগসাজশের অভিযোগ : মার্চে ভারতে ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর বৈঠক নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক চাপের মুখে পড়ে বিএনপি। ১৫ মে ঢাকা থেকে আসলাম চৌধুরীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বর্তমানে কারাগারে আছেন আসলাম। তবে বিএনপি বলছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে  ফাঁসানো হয়েছে আসলামকে।

আজও হয়নি রামপাল অভিমুখে লংমার্চ : রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে বছরজুড়েই আলোচনা-সমালোচনা চলেছে দেশে। সুন্দরবনের কাছে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে নির্মিতব্য এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিএনপি তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে আগস্ট মাসে।

২১ আগস্ট জোটের নেতাদের বৈঠকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে জনসভা ও রামপাল অভিমুখে লংমার্চ করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এ বিষয়ে কার্যকর কোনো কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামতে পারেনি দলটি। কেবল নাগরিক সংগঠন তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি রামপালের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের যে কর্মসূচি নেয় তাতে বিএনপি সমর্থন দেয়। এ নিয়ে দলকে সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়।

জিয়ার কবর সরানো নিয়ে টেনশন : দলীয় ইস্যুতেও বিএনপি কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি, এমন অভিযোগও আছে দলটির নেতাকর্মীদের কাছ থেকে। জাতীয় সংসদ ভবনের জন্য করা লুই আই কানের মূল নকশা বাস্তবায়নে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবর সেখান থেকে সরানোর চিন্তা-ভাবনায় রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। তবে বিভিন্ন বক্তব্যে এর প্রতিবাদ জানালেও দলীয়ভাবে কার্যত জোরালো কোনো প্রতিবাদ গড়তে পারেনি বিএনপির হাইকমান্ড, যা দলের বিভিন্ন নেতাকর্মীকে হতাশ করেছে।

নিরাশ করল নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন : রাজনীতির মাঠে অনেকটা নিষ্ক্রিয় বিএনপি বছরের শেষ দিকে ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর জয় নিয়ে আশাবাদী ছিল। বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর কাছে ৭৯ হাজার ৫৬৭ ভোটে হারেন। 

এদিকে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করছেন, ‘নতুন বছরে বিএনপির প্রধান চ্যালেঞ্জ গণতন্ত্র ফেরানো।’ তার মতে, ‘এককথায় গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনাই প্রধান লক্ষ্য বিএনপির।’ তিনি যোগ করেন, ‘গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য যা যা করা দরকার, তাই করব। গণতন্ত্রহীন ও প্রায় একদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য সংগঠন ও জাতীয় ঐক্য বেশি প্রয়োজন। সে লক্ষ্যেই কাজ করছি।’

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিএনপির অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান। চট্টগ্রামের এই প্রভাবশালী নেতা মনে করেন, ‘গণতন্ত্রের জন্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচন প্রয়োজন হলেও নাগরিক প্রসঙ্গগুলোও প্রভাববিস্তারী হতে পারে। সেক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ব্যাংকলুট, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন বিষয় স্বাভাবিকভাবে সামনে আসবে। 

এ কারণে সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতৃত্বে আন্দোলনে রাজপথে-মঞ্চে না এলেও অভিন্ন ইস্যুতে সমমনা দলগুলো স্ব-স্ব অবস্থানে থেকেই যেন আন্দোলন চালিয়ে যায়, বিএনপি সেই চেষ্টাই করবে। এ লক্ষ্যে বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা ও দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শকে সামনে আনতে হবে।’

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!