• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
SonaliNews

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত নিউজ পোর্টাল

কালের সাক্ষী বিউটি বোর্ডিং: এখনো নস্টালজিয়ার প্রাণকেন্দ্র


ইমরান হোসেন নভেম্বর ১৩, ২০২৫, ০৮:৪৯ পিএম
কালের সাক্ষী বিউটি বোর্ডিং: এখনো নস্টালজিয়ার প্রাণকেন্দ্র

ছবি: প্রতিনিধি

রাজধানীর পুরান ঢাকার বাংলা বাজারের বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষা শ্রীশচন্দ্র লেনের ১ নম্বর বাড়ি—এই ঠিকানাতেই দাঁড়িয়ে আছে সময়ের সাক্ষী ‘বিউটি বোর্ডিং’। ছোট একটি গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে হলুদ রঙের প্রাচীন দোতলা ভবন, ফুলের বাগানে ঘেরা প্রশস্ত উঠোন আর দেয়ালে টাঙানো পুরনো আড্ডার ছবি। ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এই জীবন্ত প্রতীক একসময় ছিল কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনীতিক ও মুক্তিকামী মানুষের প্রাণের মিলনমেলা।

সময়ের প্রবাহে সেই জৌলুস অনেকটাই ম্লান, কিন্তু স্মৃতির দেয়ালে আজও ঝুলে আছে সোনালি দিনের অসংখ্য গল্প।

চল্লিশের দশকে প্রতিষ্ঠিত বিউটি বোর্ডিং দ্রুতই হয়ে ওঠে সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনস্ক মানুষের অন্যতম আড্ডাখানা। এখানে নিয়মিত আসতেন পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আহমদ ছফা, আল মাহমুদ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, জহির রায়হান, খান আতা, সত্য সাহা, সমর দাস ও জুয়েল আইচসহ অসংখ্য খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব।

এখানেই আবদুল জব্বার খান লিখেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম সবাক ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’-এর পাণ্ডুলিপি। কবি ফজল শাহাবুদ্দিন এখান থেকে প্রকাশ করেছিলেন সাহিত্যপত্রিকা কবিকণ্ঠ। আহমদ ছফার স্বদেশ পত্রিকার জন্মও হয়েছিল এখানেই।

১১ কাঠা জমির ওপর নির্মিত এই ভবনটি একসময় ছিল নিঃসন্তান জমিদার সুধীরচন্দ্র দাসের মালিকানাধীন। দেশভাগের আগে এখানে ছিল সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার অফিস—যেখানেই ছাপা হয়েছিল কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা।

১৯৪৯ সালে প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও নলিনী মোহন সাহা এই ভবনে শুরু করেন আবাসিক ও খাবার হোটেল ‘বিউটি বোর্ডিং’। নামটি রাখা হয় নলিনী সাহার মেয়ে বিউটির নামে।

১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালায় বিউটি বোর্ডিংয়ে। শহীদ হন এর অন্যতম কর্ণধার প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহাসহ ১৭ জন মুক্তিকামী মানুষ। উঠোনে স্থাপিত শহীদ স্মৃতিফলক আজও সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রতিভা সাহা দুই ছেলে সমর ও তারক সাহাকে নিয়ে পুনরায় প্রতিষ্ঠানটি চালু করেন। আগের মতো সাহিত্য-আড্ডা না থাকলেও খাবার ঘরে এখনো ভোজনরসিকদের পদচারণা লেগে থাকে। ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখনো এখানে স্টিলের থালা ও গ্লাসে খাবার পরিবেশন করা হয়।

বর্তমানে ২৫টি কক্ষের বেশিরভাগই খালি থাকে। বড় কক্ষের ভাড়া ১,২০০ টাকা, আর সিঙ্গেল রুম ২০০-৩০০ টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়।

১৯৭৫ সাল থেকে বিউটি বোর্ডিংয়ের সঙ্গে আছেন বর্তমান ম্যানেজার বিজয় পোদ্দার। লোকসান গুনেও প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে যাচ্ছেন কেবল ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্য। তার ভাষায়, সরকারি সহায়তা না পেলে হয়তো বেশিদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।

তিনি স্মরণ করেন একদিনের ঘটনা—পল্লীকবি জসীমউদ্দীন নিজ পরিচয় দেওয়ার পরও তিনি চিনতে পারেননি। তখন কবি নিজের লেখা কবর কবিতার কয়েকটি পংক্তি শুনিয়ে ছিলেন। সেই মুহূর্ত আজও তাঁর মনে গেঁথে আছে।

১৯৯৫ সালে সাবেক ‘বিউটিয়ান’দের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘বিউটি বোর্ডিং সুধী ট্রাস্ট’। ২০০৩ সালে কবি ইমরুল চৌধুরী আহ্বায়ক ও তারক সাহা সদস্য সচিব হিসেবে ৬০ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেন। ২০০৫ সাল থেকে শুরু হয় ‘বিউটি বোর্ডিং সম্মাননা’-যা প্রতিবছর সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রদান করা হয়।

সময় পাল্টেছে, তবুও বিউটি বোর্ডিং টিকে আছে তার ঐতিহ্যের ছায়া বুকে নিয়ে। সাহিত্য-আড্ডা কমে গেলেও এখানকার চা, কফি আর দুপুরের খাবার এখনো টানে পুরান ঢাকার মানুষকে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা বলেন, ইউটিউবে বিউটি বোর্ডিং নিয়ে অনেক কিছু দেখেছি, কিন্তু সরাসরি এসে মনে হলো, যেন পুরনো এক সাহিত্য আড্ডায় ফিরে গেছি। আরেক শিক্ষার্থী ইব্রাহিম মণ্ডল বলেন, মন খারাপ থাকলে এখানে চলে আসি। শহরের মধ্যে এমন নস্টালজিক পরিবেশ আর কোথাও নেই।

স্ত্রীকে নিয়ে আসা দর্শনার্থী আরিফ হোসেন বলেন, পুরান ঢাকার এই শান্ত পরিবেশে বসে আড্ডা দেওয়া আর সময় কাটানো-এক কথায় অন্যরকম অভিজ্ঞতা।

কালের সাক্ষী এই বিউটি বোর্ডিং এখনো ধরে রেখেছে ঢাকার সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের এক অবিনাশী অংশ। সময়ের ধুলোয় কিছুটা মলিন হলেও এটি এখনো নস্টালজিয়ার প্রাণকেন্দ্র—পুরান ঢাকার হৃদয়ে জেগে থাকা এক সাংস্কৃতিক বাতিঘর।

লেখক: ইমরান হোসেন, শিক্ষার্থী, কবি নজরুল সরকারি কলেজ

এসএইচ 

Wordbridge School
Link copied!